শিম চাষ পদ্ধতি-বীজ থেকে বাজারজাতকরণ পর্যন্ত সম্পূর্ণ নির্দেশিকা
শিম বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় সবজি। এটি প্রোটিনসমৃদ্ধ, পুষ্টিকর এবং কম খরচে অধিক ফলনশীল ফসল। দেশে প্রায় সারাবছরই শিম চাষ করা হয়।ময়মনসিংহ,বগুড়া, রংপুর অঞ্চলে প্রচুর শিম চাষ হয়। নিচে শিম চাষের ধাপ সমূহ। ধাপে বিস্তারিত নির্দেশিকা আলোচনা করা হয়েছে — বীজ নির্বাচন থেকে বাজারজাতকরণ পর্যন্ত।
১. শিমের পরিচিতি
শিম লতাজাতীয় ফসল, যা সাধারণত উষ্ণ ও শুষ্ক আবহাওয়ায় ভালো জন্মায়। বাংলাদেশের প্রায় সব জেলায় শিম চাষ হয়। এটি প্রোটিন, ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন সমৃদ্ধ। গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন উভয় মৌসুমেই শিমের চাষ করা যায়।বিশেষ করে শীতকালে শিম চাষের প্রচলন একটু বেশি।
২. উপযোগী জাত নির্বাচন
উচ্চ ফলনশীল কিছু জনপ্রিয় জাত হলোঃ
- বর্ষাকালীন শিম — বারি শিম-১, বারি শিম-২
- শীতকালীন শিম — আই.পি.এল-৯, বিজয়, অনন্যা
- দেশি জাত — দেশি লম্বা, বাটি শিম, সাদা শিম
জাত নির্বাচন করার সময় স্থানীয় আবহাওয়া, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ও বাজার চাহিদা বিবেচনা করা উচিত।
৩. মাটি ও জমি প্রস্তুতি
দোআঁশ বা বেলে-দোআঁশ মাটি শিম চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। জমিতে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা ভালো থাকা প্রয়োজন। বপনের আগে জমি ৩–৪ বার চাষ দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে নিতে হবে। জমির চারদিকে ফসল সুরক্ষার জন্য বেড়া দিতে হবে।
সার প্রয়োগ
- গোবর সার – ১০–১৫ টন/হেক্টর
- ইউরিয়া – ১২০ কেজি/হেক্টর
- টিএসপি – ১৫০ কেজি/হেক্টর
- এমওপি – ৭০ কেজি/হেক্টর
বপনের আগে গোবর সার এবং টিএসপি সার মিশিয়ে দিতে হবে। ইউরিয়া ও এমওপি সার দু’ভাগে ভাগ করে প্রয়োগ করতে হয়।
৪. বপন সময় ও পদ্ধতি
শীতকালীন জাত সাধারণত সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বপন করা যায় এবং গ্রীষ্মকালীন জাত ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাসে বপন উপযুক্ত। প্রতি গর্তে ২–৩টি বীজ ২–৩ সেমি গভীরে বপন করতে হয়। সারি থেকে সারি দূরত্ব ৬০ সেমি এবং গাছ থেকে গাছ ৪০ সেমি।
৫. সেচ ও আগাছা নিয়ন্ত্রণ
জমি সবসময় আর্দ্র রাখতে হবে। অঙ্কুরোদ্গমের পর প্রথম সেচ দিতে হয় এবং পরবর্তী সেচ ৭–১০ দিন পরপর। শীতকালে গাছের গোড়ায় প্রতিদিন সেচ দিলে অধিক পরিমাণ ফলন পাওয়া যায়।আগাছা দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে তুলে ফেলতে হবে, না হলে ফলন কমে যায়।
৬. খুঁটি ও মাচা তৈরি
শিমের লতা যাতে সহজে উপরে উঠতে পারে, সে জন্য খুঁটি ও মাচা তৈরি করা জরুরি। সাধারণত ২–২.৫ মিটার উঁচু খুঁটি দিয়ে বাঁশ বা দড়ি ব্যবহার করে মাচা বানানো হয়।
৭. রোগ ও পোকামাকড় দমন
শিমের সাধারণ রোগসমূহঃ ছত্রাকজনিত ছোপ রোগ, ফুল ঝরা, ফল পচা ইত্যাদি।
- রোগ প্রতিরোধে বীজ ফাঙ্গিসাইড দিয়ে প্রক্রিয়াজাত করতে হবে।
- আক্রান্ত গাছ তুলে ফেলুন এবং জমি শুকনো রাখুন।
- জৈব কীটনাশক ব্যবহার করলে মানুষের ক্ষতি কম হয়।
৮. ফল সংগ্রহ
বপনের ৫০–৬০ দিন পর শিম সংগ্রহ করা যায়। ফল যখন কোমল ও সবুজ থাকে তখনই তোলা উচিত। দেরি করলে ফল শক্ত হয়ে বাজারমূল্য কমে যায়।
৯. ফলন ও বাজারজাতকরণ
প্রতি হেক্টরে গড়ে ১৫–২০ টন শিম উৎপাদন সম্ভব। বাজারে শীতকালে শিমের দাম বেশি থাকে, তাই এই মৌসুমে চাষ করলে লাভজনক হয়। তাজা শিম বিক্রির সময় পানি ছিটিয়ে রাখলে তা দীর্ঘ সময় সতেজ থাকে।
১০. শিম চাষে লাভ-ক্ষতি বিশ্লেষণ
প্রতি বিঘায় গড়ে ১২–১৫ হাজার টাকা খরচ হয়। সঠিক পরিচর্যা করলে ৩০–৪০ হাজার টাকার শিম বিক্রি করা সম্ভব। অর্থাৎ, বিঘা প্রতি ন্যূনতম লাভ প্রায় ১৫–২০ হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে।
প্রশ্নোত্তর (FAQ)
প্রশ্ন: শিম চাষের জন্য কোন মাটি সবচেয়ে উপযুক্ত?
উত্তর: দোআঁশ বা বেলে দোআঁশ মাটি, যেখানে পানি নিষ্কাশন ভালো।
প্রশ্ন: প্রতি হেক্টরে কত ফলন পাওয়া যায়?
উত্তর: প্রায় ১৫–২০ টন পর্যন্ত শিম উৎপাদন সম্ভব।
প্রশ্ন: শিমে কোন সার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ?
উত্তর: গোবর সার, টিএসপি ও ইউরিয়া সার — সুষমভাবে প্রয়োগ করতে হবে।
উপসংহার
শিম চাষ বাংলাদেশে ছোট কৃষকের আয়ের একটি বড় উৎস হতে পারে। নিয়মিত সেচ, আগাছা নিয়ন্ত্রণ ও রোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিলে উৎপাদন অনেক বাড়ানো যায়। তাই প্রতিটি কৃষক যদি আধুনিক পদ্ধতিতে শিম চাষ শুরু করেন, তাহলে এটি গ্রামীণ অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে আশা করা যায়।
আরও পড়ুন:গ্রামীন কৃষিতে নতুন সম্ভাবনা -চিচিঙ্গা চাষের সফল পদ্ধতি।
